শ্রীশ্রীঠাকুরের সেবায় ও সাহচর্য্যে শ্রদ্ধেয় সুশীলদা পঞ্চাশোর্ধ বছর কাটিয়েছেন। এত দীর্ঘকাল তাঁর সান্নিধ্যে থাকার পর আর কেউ লিখিত বিবরণ রেখে যাননি; সেদিক থেকে এর একটা স্থায়ী মূল্য আছে। তাছাড়া এ বইয়ে যা’ কিছু আছে তা অনেকাংশে তাঁর নিজেরই প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ধারা-বিবরণী,অন্যের কাছে সংগ্রহ করা তথ্যের সংকলন নয়। আর একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় যে এতে শ্রীশ্রীঠাকুরের মতবাদ,বাণী বা শিক্ষার প্রসঙ্গ আদৌ আলোচিত হয়নি,কিন্তু যে গুণে আকৃষ্ট হ’য়ে বিভ্রান্ত মানুষ তাঁকে একান্ত নির্ভরযোগ্য আশ্রয় ব’লে গ্রহণ করেছে, শ্রীশ্রীঠাকুরের সেই অপার করুণা,ক্ষমা ও ধৈর্য্যের চিত্রই লেখক অঙ্কিত করেছেন। …’পরম কারুণিক যিনি,তাঁকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত কর, তোমার নিশ্চলা বুদ্ধি তাঁর মতবাদকে আলিঙ্গন ক’রে ধন্য হবে’- এই ইঙ্গিতই যেন তাঁর লেখার ভেতর প্রচ্ছন্ন হ’য়ে আছে।
ভক্তির এক লক্ষণ নাকি নির্ব্বিচারতা, কিন্তু তারই সঙ্গে বিশ্লেষণী বুদ্ধির
পরিচয় পাই লেখকের চরিত্রে I শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে যখন যা’ নির্দ্দেশ দিয়েছেন
তা নির্ব্বিচারে পালন করলেও, সর্ব্বক্ষেত্রেই কার্য্যকারণের সমাধানও পরে
চেয়ে নিয়েছেন ; কাহিনীতে তার উল্লেখ থাকায় অলৌকিকত্বের গ্লানি এতে
কোথাও নেই I আর নেই কোনও অহমিকার প্রকাশ,-‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ম’-
এই উক্তি যেন তাঁর ব্যক্তিত্বে সার্থক হ’য়ে উঠেছিল।
‘বিনয়’ কথাটির প্রচলিত অর্থ ‘নম্রতা’, কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকূর তা স্বীকার
করতেন না I বলতেন, এর ধাতুগত মানে, অপরকে স্বীয় মতে ‘আনয়ন’ করার কৌশল।
( ‘বিনয়’ ও ‘আনয়ন’ একই ধাতু থেকে উৎপন্ন) I অপরের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণের চতুরতা ও পরাক্রম না থাকলে বিদ্যা নিস্ফলা। সুশীলদার চরিত্রে এই সংজ্ঞারই রূপ দেখেছি, তারই উদাহরণ স্বরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ ক’রে এই ভূমিকার উপসংহার
করি ।
বিহারে সাঁওতাল পরগণার জেলা কংগ্রেস কমিটির প্রাক্তন সেক্রেটারী শ্রীবিষ্ণুপ্রসাদ রায়
একবার দেওঘর থেকে দুমকা যান ৷ নানা কাজ সারতে শেষ বাসের সময় উত্তীর্ণ হ’য়ে গেল, অথচ সে রাত্রেই দেওঘর না ফিরলে নয় I অগত্যা তিনি বন্ধু উকীল কুমারীশবাবুর বাড়ী গেলেন তাঁর কাছে সাইকেল চাইতে।কিন্তু বন্ধুর ঘোর আপত্তি,-রাত্রে ৪২ মাইল নির্জ্জন পথ কিছুতেই সাইকেলে পাড়ি দেওয়া চলবে না । তাঁকে বসিয়ে জলযোগের ব্যবস্থা ক’রে বললেন,“দেখনা, তোমার ফেরার ভাল ব্যবস্থাই করছি।”
আশ্রম তখন এক মিথ্যা মামলায় জড়িত,তারই তদ্বিরে সুশীলদার কুমারীশবাবুর কাছে আসার কথা।তিনি এলে তাঁর সঙ্গে বিষ্ণুবাবুর পরিচয় করিয়ে বললেন, “এঁর কাজ মিটলে,এঁর গাড়ীতেই যাও।” তারপরের কথা বিষ্ণুবাবুর নিজ মুখে যা শুনেছি,তা হ’ল এই-
‘সৎসঙ্গের অনেক নিন্দা আমার কানে আগেই গিয়েছিল, এই মামলার
পর ধারণা আরও বিরূপ হয় I আমার ইতস্ততঃ করা দেখেই সুশীলদা
ব’লে উঠলেন,- দেখুন বিষ্ণু্বাবু, আপনি তো আসার সময়ে বাসে এসেছেন ;
আপনার সঙ্গে একই গাড়ীতে যেমন কিছু ভাল লোক এসেছে, কিছু মন্দ
চরিত্রের লোকও নিশ্চয় এসে থাকবে । তাদের পাপ যখন আপনাকে স্পর্শ করেনি, তখন এক মন্দ প্রতিষ্ঠানের ততোধিক মন্দ লোকের সঙ্গে এক গাড়ীতে যদি ফেরেন, তাতেই বা দোষ হবে কেন ? আপনি নিঃসঙ্কোচে আমার গাড়ীতেই চলুন।
‘গাড়ীতে যে সব কথা হ্'ল তা আজ আমার মনে নেই; তবে এর পর দেওঘরের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, সৎসঙ্গের সম্বন্ধে কুৎসা করার আমি ব’লেছিলাম, আপনি কি এটা নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জেনেছেন ? লোকমুখে শুনে কিছু বলা অতি গর্হিত কাজ ৷
‘সৎসঙ্গের নিন্দাবাদ তখন দেওঘরে একটা সর্ব্বজন-উপভোগ্য জিনিষ, হঠাৎ এই ছন্দপতনে চকিত হ’য়ে তিনি ব’লে উঠলেন,-সৎসঙ্গের এতবড় ভক্ত তুমি কবে থেকে হ’লে ?
‘আমি তা’তে উত্তর দিলাম,- আপনি বিলক্ষণ জানেন আমি আজও সৎসঙ্গের ধারে কাছেও যাইনি৷ তবে সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত একজন মানুষের নৈতিক মেরুদণ্ড এত মজবুত দেখেছি যে আমার দৃঢ় ধারণা, সহস্র প্রতিকূল শক্তিও এ প্রতিষ্ঠানকে এতটুকু টলাতে পারবে না ।
বস্তুতঃ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাের প্রবৃত্তি তিনি আমার এতদূর
জাগিয়ে তুলেছিলেন যে আমি স্বেচ্ছায় সারা জিলার বিশিষ্ট লোকদের বাড়ী
গিয়ে সৎসঙ্গ সম্বন্ধে তাঁদের বিরূপ মনোভাব নিরসন না ক’রে ক্ষান্ত হইনি I’
… শ্রদ্ধেয় বিষ্ণুদা এখন আমাদের একজন অন্তরঙ্গ ইষ্টভ্রাতা I